শেষ বিকেলের আলোয় পার্কের বেঞ্চিটায় একাই বসে ছিল অয়ন। হাতে তার প্রিয় লেখকের নতুন বই, কিন্তু একটা পাতাও ওল্টানো হয়নি। তার ভাবনার সবটুকু জুড়ে ছিল নীলা। আজ তাদের দেখা করার কথা ছিল, এখানেই। এই পার্ক, এই বেঞ্চিটা তাদের খুব প্রিয় জায়গা। কত শত বিকেল তারা এখানে একসাথে কাটিয়েছে, তার কোনো হিসাব নেই।
নীলার সাথে অয়নের পরিচয়টা বেশ অদ্ভুতভাবে। এক বৃষ্টিভেজা বিকেলে দুজনেরই ছাতা ছিল না। দৌড়ে এই পার্কের এক ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে গিয়েই প্রথম কথা। সেই দিনের পর থেকে তাদের পৃথিবীটা যেন এক হয়ে গিয়েছিল। একসাথে ফুচকা খাওয়া, রিকশায় ঘুরে বেড়ানো, আর অয়নের লেখা কবিতা শোনা—নীলার প্রিয় কাজ ছিল এসব।
কিন্তু গত কয়েক মাস ধরে সবকিছু কেমন বদলে যেতে শুরু করেছে। নীলার বাবা তার বিয়ে ঠিক করেছেন এক প্রবাসী পাত্রের সাথে। নীলা প্রথমে রাজি না হলেও, পরিবারের চাপের কাছে তাকে হার মানতে হয়েছে। অয়নকে সে কিছুই বলতে পারেনি, শুধু এড়িয়ে গিয়েছে। অয়ন বুঝতে পারলেও, নীলার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় ছিল।
আজ সকালে নীলাই ফোন করে দেখা করতে বলেছে। অয়নেরใจটা ধুকপুক করছিল। সে জানে আজ হয়তো শেষ দেখা। তবু একবুক আশা নিয়ে সে অপেক্ষা করছিল।
সূর্যটা যখন প্রায় ডুবে গিয়েছে, তখন দূর থেকে নীলাকে দেখা গেল। লাল পাড়ের একটা সাদা শাড়ি পরেছে সে, কপালে ছোট একটা লাল টিপ। অয়নের দিকে তাকিয়ে সে হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু হাসিটা তার চোখ পর্যন্ত পৌঁছাল না।
কাছে এসে নীলা কোনো কথা না বলে অয়নের পাশে বসল। কিছুক্ষণ চুপচাপ। নীরবতাই যেন তাদের সব কথা বলে দিচ্ছিল। অবশেষে নীলাই প্রথম কথা বলল, "আমায় ক্ষমা করে দিস, অয়ন।"
অয়ন নীলার দিকে না তাকিয়েই বলল, "ক্ষমা চাওয়ার কিছু নেই। আমি সব জানি।"
নীলার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। কাঁপা কাঁপা গলায় সে বলল, "আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারলাম না। বাবার সম্মানটা নষ্ট করতে পারিনি।"
অয়ন এবার নীলার দিকে তাকাল। তার চোখে কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল শুধু গভীর ভালোবাসা আর একরাশ কষ্ট। সে নীলার হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, "আমি তোমাকে বুঝি, নীলা। তোমার কোনো দোষ নেই। আমি শুধু চাই তুমি ভালো থেকো।"
নীলা অয়নের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। অয়ন তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না। শুধু আলতো করে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।
অনেকক্ষণ পর নীলা কান্না থামিয়ে বলল, "আমার জন্য অপেক্ষা করিস না। নিজের জীবনটা গুছিয়ে নিস।"
অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, "আমার জীবন তো তোমার সাথেই জড়িয়ে গিয়েছিল, নীলা। এখন একা একা কীভাবে গুছিয়ে নেব জানি না। তবে চেষ্টা করব।"
নীলা উঠে দাঁড়াল। যাওয়ার আগে সে তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট বাক্স বের করে অয়নের হাতে দিল। বলল, "এটা তোমার জন্য।"
অয়ন বাক্সটা খুলে দেখল, ভেতরে একটা সুন্দর কলম। কলমটার গায়ে খোদাই করে লেখা—"তোমার জন্য"।
নীলা আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। দ্রুত পায়ে পার্ক থেকে বেরিয়ে গেল। অয়ন সেদিকেই তাকিয়ে রইল, যতক্ষণ না নীলা চোখের আড়াল হয়ে যায়।
সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে এসেছে। পার্কের আলো গুলো জ্বলে উঠেছে। অয়ন একা বেঞ্চিতে বসে রইল, হাতে সেই কলমটা। তার মনে হলো, এই কলমটা শুধু একটা উপহার নয়, এটা নীলার ভালোবাসার শেষ স্মৃতি। যে স্মৃতিটা তাকে সারাজীবন আগলে রাখতে হবে।
সে ঠিক করল, এই কলম দিয়ে সে তার আর নীলার অসমাপ্ত ভালোবাসার গল্প লিখবে। যে গল্পটা শুধু তারই থাকবে, একান্ত আপনার। আর সেই গল্পের প্রতিটি অক্ষর লেখা হবে শুধু একজনেরই জন্য—তার নীলার জন্য।