🌿 কাজের মেয়ে
রোদ যখন নরম হয়ে আসে, তখনো শহরের গলি-ঘুপচি গুলোতে ব্যস্ততা কমে না। ঢাকা শহরের এই পুরনো এলাকায়, চারতলা এক বাড়ির নিচতলায় থাকে রুপা। বয়স সবে বারো। মা-বাবা নেই। ছোটবেলায় বাবা মারা যায়, তারপর মা রুগ্ন হয়ে পড়ে। অভাবের সংসার। মায়ের চিকিৎসা আর চাল-ডালের টানাটানিতে শেষ পর্যন্ত একদিন মা-ও বিদায় নিলো। রুপা তখন একা।
পাড়ার এক খালা তাকে এই বাসায় কাজে লাগিয়ে দেন। বড়লোকের বাড়ি। মালিকের স্ত্রী শিখা আপা অনেকটা রুক্ষ স্বভাবের। সকাল হলে রুপার ঘুম ভাঙে পেছনের ছোট্ট রান্নাঘরের মেঝেতে, যেখানে তার বিছানা। তারপর শুরু হয় দিনের হিসেব-অসীম কাজের লিস্ট— বাসন মাজা, কাপড় ধোয়া, বাচ্চাকে স্কুলের জন্য প্রস্তুত করা, বাজার থেকে জিনিস আনা। সবকিছু করতে করতেই দুপুর গড়িয়ে যায়।
রুপার হাতে কোন খেলনা নেই। নেই কোন স্বপ্নের গল্পের বই। কেবল আছে কিছু পুরনো কাপড়, আর ক’টা ছোট্ট চিরুনি। মাঝেমধ্যে দুপুরবেলা মালিকের মেয়ে যখন স্কুল থেকে ফেরে, ব্যাগের ভেতর রঙিন চক আর চকলেট দেখে রুপার মন হুহু করে ওঠে। কখনো সাহস হয় না কিছু চাইতে।
একবার, খুব জ্বর উঠেছিল। গলা শুকিয়ে কাঠ। গিয়ে বলেছিল, “আপা, একটু ওষুধ দেবেন?”
শিখা আপা ভ্রু কুঁচকে বলেছিলেন, “এখন এসব নিয়ে টানাটানি করো না। কাজ শেষ করে নাও, তারপর দেখা যাবে।”
জ্বর নিয়ে বাসন মাজতে মাজতে চোখে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল মা থাকলে বুঝি এই কষ্ট হতো না।
কিন্তু রুপা কখনো গলা উঁচু করে কিছু বলেনি। ছোট্ট এই জীবনেই বুঝে গেছে, তার কথা শোনার মতো কেউ নেই।
সন্ধ্যায় বাড়ির ছোট ছেলে আর মেয়ের হোমওয়ার্কে সাহায্য করতে হয়। রুপা পড়তে জানে, ক্লাস তিনে পড়তে পড়তে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। যখন ওদের বাংলা বই খুলে দেয়, মনটা কেমন কুঁকড়ে যায়—“আচ্ছা, আমি কি আর কোনদিন স্কুলে যাবো না?”
রাতে সবার খাবার পরে, পাত্র থেকে বেঁচে যাওয়া খাবার নিয়ে বসে। তখন মনেপ্রাণে ভাবে—এই শহরে কত আলো, কত গাড়ি, কত রঙিন শপিংমল—কিন্তু তার জন্য নেই কোনো কোণ।
একবার বাড়ির মালিক বড় মানুষের বাসায় দাওয়াত খেতে গিয়েছিলেন। সেদিন বাড়ি ফাঁকা। রুপা রান্নাঘর গুছিয়ে বসে জানালার ফাঁক দিয়ে আকাশ দেখছিল। তার ছোট্ট হাতের তালুতে অদৃশ্য স্বপ্নগুলো জমে আছে—একটা স্কুলব্যাগ হবে, রঙিন জামা হবে, ক্লাসের বেঞ্চে বসে নতুন বইয়ের গন্ধ নেবে। কিন্তু জানে—এসব শুধু স্বপ্ন, বাস্তব নয়।
মাঝে মাঝে ছুটির দিনে কাজের খালা আসে। খালা তার জন্য একটু বাতাসা আনেন। তখন মনে হয়, কেউ বুঝি তার খবর রাখে। এই সামান্য স্নেহেই সে নতুন করে বাঁচে।
দিন যায়, রাত আসে। রুপা বড় হয়। বড় হতে হতে কেবল বোঝে—এই ঘর, এই বাসন, এই দায়িত্বই তার সব। একদিন হঠাৎ শুনলো, মালিকের পরিবার গ্রামে যাবে, কিছুদিনের জন্য বাড়ি বন্ধ থাকবে। রুপাকে বলা হলো গ্রামের এক আত্মীয়ের বাসায় কাজ করতে।
রুপা নিজের ছোট্ট ব্যাগ গুছাতে গিয়ে জানালার ফাঁক দিয়ে আবার আকাশের দিকে চেয়ে রইলো। আকাশের তারা ঝিকিমিকি করে। মনে হলো—ওরা হাসছে, ডাকছে—“রুপা, কখনো ভেবো না তুমি একা। তুমিও এই আকাশের নিচের মানুষ।”
মনের ভেতর অদ্ভুত শক্তি হলো। ব্যাগ হাতে বেরিয়ে এল সে। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল নতুন বাড়ির দিকে। ভাবলো—যেখানেই যাই, আমি বাঁচবো। একদিন নিজেও নিজের একটা ঘর বানাবো। নিজের একটা পরিচয় হবে।
এই শহর তাকে শিখিয়েছে—কষ্টের আড়ালে যে স্বপ্ন থাকে, তার আলো নিভে যায় না। হয়তো একদিন সেই আলোয় তার জীবনও আলো হবে।
গল্পের নাম: কাজের মেয়ে
গল্পের আকার: ~১৫০০ শব্দ
টোন: সংবেদনশীল, দুঃখ ও আশার মিশেল